বাংলাদেশের ইতিহাসে অলি আহাদ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ। ভাষা আন্দোলনে তার অসামান্য অবদান তাকে এক অনন্য স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। মূলত তিনি একজন প্রথম সারির ভাষা সৈনিক ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার ইসলামপুর নামক গ্রামে ১৯২৮ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। অলি আহাদের পিতা তৎকালীন ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার মরহুম আবদুল ওহাব ছিলেন।
অলি আহাদ ১৯৪৪ সালে দাউদকান্দি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করেন। পরে তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এরপর তিনি ১৯৪৭ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.কম এ ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. কম পরীক্ষায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম পড়ার সুযোগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করেছিল। তারপর দীর্ঘ ৫৮ বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আদেশ প্রত্যাহার করেন।
১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে গণভোটে তিনি ত্রিপুরা জেলার ৪ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্কাস ক্যাম্পের অন্যতম সদস্য ছিলেন ৷ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের কারণে ১৯৪৬ সালে আই, এস-সি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি ৷ শিক্ষাজীবনের একটি বছর তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে ৷ তিনি ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারিতে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি প্রথম কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়েছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা: জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহ্ পাল্টা বাংলা ভাষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমুদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রচারাভিযান শুরু করে। পাকিস্তানের গনপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়ায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঐ দিন পুলিশ ছাত্রদের বাধা দেয় এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। বন্দী নেতাদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলি, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ।
অলি আহাদ ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্মপরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ঢাকা শান্তি রিলিফ কমিটি গঠন করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। সরকারের বন্ধ্যা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তিনি ১৯৫০ সালের ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলনে অলি আহাদকে আহবায়ক করে গণশিক্ষা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল।
১৯৫১ সালের ২৭-২৮ মার্চ যুব সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হলে অলি আহাদ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের শেষার্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগের অনেক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এসময় অলি আহাদ যুবলীগকে শক্তিশালী একটি সক্রিয় সংগঠনে পরিণত করেন। ১৯৫১ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামক একটি ছাত্র সমিতি গঠন করেন যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে আত্মপ্রকাশ করে। এ বছরই সরকারের অত্যাচার ও বিরোধী সমালোচকদের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি নাগরিক স্বাধীনতালীগ গঠন করেন।
১৯৫২ সালের ২৬/২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দীন ঊর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। অলি আহাদ এ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, বিক্ষোভ সভা ও মিছিলের আহবান করে। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু অলি আহাদ ও আবদুল মতিনসহ ৪ জন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহমুদ আন্দোলনের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে সরে দাঁড়ান। এমন সংকটময় অবস্থায় অলি আহাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পরামর্শেই ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করে তিনি ১৯৫৪ সালে এর প্রচার সম্পাদক ও ১৯৫৫ সালে এর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরোধিতা করেন।
১৯৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাগমারিতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অলি আহাদ ও ভাসানীসহ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একাংশের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতবিরোধ হলে ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এপ্রিলে অলি আহাদ দল থেকে বহিষ্কৃত হলে রাজনৈতিকভাবে ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৫৯-১৯৬২ সাল পর্যন্ত কারাবাসের পর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ভারত ঘেঁষানীতির বিরোধিতা করে তিনি বাংলা জাতীয় লীগের সাথে একাত্ম হন। তিনি মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের পর তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার হন এবং বিনা বিচারে আটক থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্ত হন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থটি সমকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০০৪ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। ঢাকা সিটি করর্পোরেশন ২০০৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর নামনুসারে ধানমন্ডির ৪নং সড়কটির নামকরণ করা করেন।
অলি আহাদ ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া