ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে ছিলেন?

933
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত Dhirendranath Datta

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একজন প্রখ্যাত বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী, ভাষা সৈনিক ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি এক অগ্রগামী নেতা হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। এছাড়াও তিনি একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেশ বিভাগের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত অংশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। 

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার রামরাইল গ্রামে। তাঁর বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ধীরেন্দ্রনাথ পড়াশোনা করেছেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ, এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। তিনি ১৯০৪ সালে নবীনগর হাই স্কুল হতে প্রবেশিকা, ১৯০৬ সালে কুমিল্লা কলেজ থেকে এফ.এ, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ হতে বি.এ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ হতে বি.এল পরীক্ষা পাস করেন।

১৯০৬ সালে ছাত্রজীবনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তৎকালীন কুমিল্লা মহকুমার মুরাদনগর থানার পূর্বধইর গ্রামের কৃষ্ণকমল দাসমুন্সীর কন্যা সুরবালা দাসকে বিয়ে করেন। কৃষ্ণকমল দাসমুন্সী পেশায় আইনজীবী ছিলেন। বিয়ের সময় ধীরেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২১ বছর এবং সুরবালার ১৪ বছর। তাঁদের সাত মেয়ে ও দুই ছেলে ছিল।

তিনি প্রায় এক বছরকাল কুমিল্লার মুরাদনগর বাঙ্গুরা উমালোচন হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯১১ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করেন। ১৯০৭ সালে ত্রিপুরা হিতসাধনী সভার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ১৯১৫ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণে বড় ভূমিকা পালন করে প্রাথমিক যশ অর্জন করেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে তিনি মুক্তি সংঘ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করেন। কুমিল্লার অভয় আশ্রম-এর কর্মকান্ডের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন এবং ১৯৩৬ সালে ত্রিপুরা জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণসামগ্রী বিতরণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে তিনি তিন মাসের জন্য আইন ব্যবসা স্থগিত রাখেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের সাথে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন কারাগারে বিনাশ্রম ও সশ্রম দণ্ড ভোগ করেন।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবী নাকচ করে দিয়েছিলেন।

১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসাবে তাকে ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। যতজন বাঙ্গালী স্ব-ভাষার জন্য মূখ্য ভূমিকা রেখে গেছেন, তাদের মাঝে প্রথম সারির নেতাদের একজন ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। 

পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর এবডো (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করা হয় এবং এর ফলে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পুত্র দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁদেরকে ময়নামতী সেনানিবাসে নিয়ে হত্যা করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অসামান্য অবদান তাকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে বাঙ্গালীর প্রাণে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here