ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই সাহসী স্বেচ্ছসেবীর গল্প

1654
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই সাহসী স্বেচ্ছসেবীর গল্প
বাঁয়ে কাব্য আক্তার এ্যানি ও ডানে সোহেল খাঁন

চিন্তা করুন, আপনি প্রতিদিন ১৫০-২০০ জন মানুষের ইফতার করাচ্ছেন, তাও আবার নিজে রান্না করে। হয়ত আপনার-আমার কাছে এই কথাটা শুনতেই অনেক অবাক লাগবে কিন্তু বাস্তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের সদ্য এস.এস.সি পরিক্ষার্থী কাব্য আক্তার এ্যানি ও প্রবাসীফেরত ব্যবসায়ী সোহেল খাঁনের প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষকে ইফতার করানো।

আপনারা সবাই জানেন, বর্তমানে করোনা ভাইরাস একটা বৈশ্বিক মহামারিতে রুপ নিয়েছে। এই ভাইরাসের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৮ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ আর এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে প্রায় ১২ লাখের বেশি মানুষ। একইভাবে এই ভাইরাসের ফলে বিশ্ববাজারে ধ্বস নেমেছে বহু আগেই, বাংলাদেশেও কোনো অংশে এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশ একটি নিম্ন আয়ের দেশ। এই দেশের প্রায় ৯ কোটি মানুষ সাধারণ শ্রমজীবীর পেশায় নিয়োজিত। এমতাবস্থায়, নিঃসন্দেহে এই ভাইরাস বাংলাদেশের জন্য অভিশাপস্বরুপ। এই ভাইরাসের ফলে আমাদের অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায় অচল ছিল দীর্ঘদিন। এই সময়টাতে দেশের অনেক উচ্চবিত্ত মানুষ, প্রতিষ্ঠান বা সরকার থেকে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছে প্রতিটি জেলায় জেলায়।

আমাদের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও এর ব্যতিক্রম নয়, প্রায় অনেকেই এগিয়ে এসেছেন এই মহান মানবকল্যানে। কিন্তু আজকে আমি যাদের নিয়ে কথা বলব তাদের গল্পটা অন্য ৮-১০টা গল্প থেকে খানিকটা ভিন্ন।

বেশ কিছুদিন আগে, আমার কাছে দুইজন স্বেচ্ছসেবী অর্থাৎ এ্যানি ও সোহেলের কাজের বর্ণনাস্বরুপ কিছু ছবি পাঠিয়েছে তাদের এক সহকর্মী রিদওয়ান আনসারি। আমি প্রথমে ছবিগুলো দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম ত বটেই কারন এত অল্প বয়সে এই ধরনের মানবিক কাজের সাথে সংযুক্ত হওয়া খুব সাধারণ কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া জানা গেল, ৭ম শ্রেনীতে পড়ার সময় থেকেই এ্যানি সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।

করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর সময়ে প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের বিভিন্ন জায়গায় কাব্য আক্তার এ্যানি ও সোহেল খাঁন এই দুইজন মিলে প্রায় ১৫০-২০০ জন হতদরিদ্র মানুষের ইফতারের আয়োজন করে যাচ্ছে। এমনকি, গত ২ এপ্রিল থেকে রমজানের আগপর্যন্ত প্রতিদিন ২০০ মানুষের মাঝে দুপুরে খাবার তুলে দিয়েছে তারা এবং পাশাপাশি ১০০০ জন অসহায় হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে। এখনোও প্রতিদিন কোন না কোন হতদরিদ্রকে বাজার করে দিয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় রমজান থেকে তারা সদরের পৌর এলাকার রেলওয়ে স্টেশন, মঠের গোড়া, জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ, লোকনাথ দিঘিরপাড় ও মসজিদ রোডসহ শহরের বিভিন্ন অলিতে-গলিতে থাকা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কাছে ছুটেছেন ইফতার নিয়ে। পুরো রোজার মাসজুড়ে তাদের এই ইফতার বিতরণ কর্মসূচী চালু থাকবে বলে জানতে পারি।

কাব্য আক্তার এ্যানি প্রায় দীর্ঘ ৪ বছর ধরে এই সমাজের অসহায় ও দুস্থ মানুষের মাঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং এই ভয়াবহ মহামারীতেও তিনি মাসব্যাপি খাবারের আয়োজন করে যাচ্ছেন। এ্যানি বলেন- ‘আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে সমাজের অসহায় মানুষের মাঝে কাজ করে যাবো’।

এ্যানির এই সকল মহৎ কাজে অর্থনৈতিক ও সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে থাকে তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা। এ্যানির এই মানবিক কাজে মুগ্ধ হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তারই ফুফাতো ভাই প্রবাসীফেরত ব্যবসায়ী সোহেল খাঁন। এ্যানি চলতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সাবেরা সোবহান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী।

 

আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অনেক জায়গার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে সংযুক্ত। তারপরেও আমার কাছে তাদের এই মহৎ কাজগুলোর প্রতি অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে। কেননা, আমরা মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগীতার উদাহরণ দেখেছি হয়ত পূর্বে কিন্তু নিজেরা রান্না করে নিজেরাই প্রতিদিন হতদরিদ্র ও ফুটপাতে আশ্রয় নেওয়া ছিন্নমূলে থাকা মানুষগুলোর জন্য ছুটতে খুব কম মানুষ বা উদাহরণই সচারচর আমাদের সমাজে দেখা যায় বা আমি দেখেছি।

আমি বিশ্বাস করি এ্যানিদের এই মহৎ উদ্যোগ একদিন সমাজের উভয় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে পড়বে। একদিন সোহেলরা আমাদের সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিতে পরিণত হবে। একদিন আমাদের মন-মানুষিকতা, চিন্তাধারায় পরিবর্তন নিয়ে আসবে, একদিন এই ঘুনেধরা সমাজের পরিবর্তন নিয়ে আসবে, একদিন আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্য জেলাদের কাছে আদর্শে পরিণত হবে।

লেখকঃ মোঃ সজীবুর রহমান সজীব