ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ
নদী-মাতৃক সমতট জনপদের বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তিতাস-বিধৌত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল, এই জেলার পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ জেলা, উত্তরে সিলেটের হবিগঞ্জ জেলা, দক্ষিনে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা জেলা অবস্থিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয় কারন এই জেলায় সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সহ আরো নানা ধরণের সংগীত শিল্পীদের জন্মস্থান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মতামত প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হতো যার কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন।
তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভী পাড়ায় বাড়ী তৈরী করে। সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ীর অবস্থানের কারণে এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাখা হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। আবার অনেকেই এই যুক্তিকে বিশ্বাস করেন না।
অন্য একটি মতানুসারে দিল্লী থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লেখিত ব্রাহ্মণ পরিবার সমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক মানুষ ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘বাউনবাইরা’ নামে ডেকে থাকে। আবার এই জেলার একটি বিকৃত নাম রয়েছে ‘বি-বাড়িয়া’ অনেকে সংক্ষেপে এই নামে ডাকে। এর ফলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন এই জেলার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ হয় যার ফলে জেলা প্রশাসন কর্তৃক বিভিন্ন কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যাতে বলা হয়েছে কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়া লেখার পরিবর্তে ‘বি-বাড়িয়া’ লিখতে পারবে না নতুবা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৮৬০ সালে মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জেলা শুরুতে ভারতের বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিল। ভারত বিভাগের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা জেলার মহকুমা হিসেবে পরিচিত লাভ করে। তারপর ১৯৮৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া, জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
আবার ১৮৩০ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্তমান সরাইল উপজেলা ময়মনসিংহ জেলার একটি পরগণা ছিল। আর ঐ সময়ে আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল সরাইল পরগনার অন্তর্গত। ইতিহাসবিদদের তথ্য মতে সর্বপ্রথম পরগণার সৃষ্টি করেন পাঠান সুলতান শেরশাহ তার রাজস্ব আদায় ও শাসন কার্য পরিচালনার জন্য। তাই বলা যায়, সুলতানী আমলেই সরাইল পরগনার সৃষ্টি হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলাকে ঐ সময় খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো, কারন বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে এই অঞ্চলটি সুখ্যাতি লাভ করেছিল। বাংলার বার ভূইয়ার শ্রেষ্ঠ ভূইয়া মসনদ-এ আলা নামে খ্যাত ঈসা খাঁ এই সরাইল উপজেলাতে তাঁর জন্ম। তিনি বাংলায় প্রথম এবং অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন সরাইলে।
ঈসা খাঁর বংশ পরিচয় থেকে জানা যায় ভারতের বাইশওয়ারা রাজ্যের এক যুবরাজ কালিদাস গজদানী সৈয়দ ইব্রাহীম মালেকুল উলামা এর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সোলায়মান খাঁ নাম ধারণ করেন। তারপর সোলায়মান খাঁ ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসেন। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের পর থেকে সর্বপ্রথম সরাইল পরগনার নেতৃত্ব দেন। এরপর সোলায়মান খাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পাঠান বাহিনী মিথ্যা সন্ধির প্রস্তাবে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে।
এই সময় ঈসা খাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। পরবর্তীতে ঈসা খাঁ ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের এক বিরাট শক্তিতে পরিনত হয়। এই অঞ্চলের স্বাধীনতা রক্ষায় তিনি মোঘল বাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ ঘটিয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ঈসা খাঁর তৎকালীন নেতৃত্ব আর তাঁর যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব তাকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। মুঘল সেনাপতি মান সিংহ জীবনে কখোনো পরাজিত করতে পারেননি ঈসা খাঁ’কে।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এলাকা ময়মনসিংহ জেলার অর্ন্তভূক্ত ছিল। ১৮৩০ সালে সরাইল, দাউদপুর, হরিপুর, বেজুরা ও সতরকন্ডল পরগনা, ময়মনসিংহ হতে ত্রিপুরা জেলার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এর অধীনস্থ হয়। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা করা হয়। তৎপূর্বেই ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর পৌরসভায় উন্নীত হয়।
১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। ১৯৬০ সালে ত্রিপুরা জেলার পূর্ব পাকিস্তান অংশের নামকরণ হয় কুমিল্লা জেলা। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি মহকুমা শহর নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা উত্তর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা এক দিকে যেমন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছে এই জেলা। এই জেলাতে জন্ম ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী উল্লাস কর দত্ত, অখিলচন্দ্র নন্দী, অতীন্দ্রমোহন রায়, নৃপেন্দ্র দত্ত রয়সহ আরো অনেক বিপ্লবীর।
পাকিস্তানের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের একমাত্র উপ-রাষ্ট্রপতি নুরুল আমিন ১৮৯৩ সালে অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ ভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতা নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা এই জেলার নাসিরনগরে জন্মগ্রহন করেন।
ব্রিটিশ ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবি আবদুর রসুল, পাকিস্তান শাসনামলের সমবায় ও পাট মন্ত্রী আবদুর রহমান খান, ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সঙ্গীতজ্ঞ আলাউদ্দিন খাঁ, আলী আকবর খান, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত কবি আবদুল কাদির ও আল মাহমুদ, ক্রিকেটার প্রবীর সেন ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল সহ অসংখ্য গুণী মানুষের জন্মস্থান আমাদের এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিল্প ও অর্থনীতি ব্যবস্থা খুবই সুপরিচিত। এই জেলার তিতাস গ্যাস ফিল্ড দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস সরবরাহ করে। তাছাড়া আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র। আশুগঞ্জ সার কারখানা দেশের ইউরিয়া সারের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প কারখানা। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া বন্দর। এই জেলা তাঁত শিল্পের জন্যও বিখ্যাত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী কিছু খেলাধুলার মাঝে নৌকা বাইচ, আসিল মোরগ লড়াই, গরুর দৌড়, ভাদুঘরের বান্নী, পুতুল নাচও বিখ্যাত।